= 1971 সালে ইরানে অনুষ্ঠিত রামসার সম্মেলনে জলাভূমির (Wetland) যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সেই অনুসারে জলাভূমি হল প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম, স্থায়ী বা অস্থায়ী, বদ্ধ বা প্রবহমান, স্বাদু বা লোনা জলের জলাশয়। সমুদ্রের জলে যে জলাভূমি পুষ্ট হয় সেখানে ভাটার সময়ে গভীরতা থাকবে 6 মিটার। জলাভূমি ভূপৃষ্ঠের যে-কোনো জায়গায় থাকতে পারে। যেমন, নদী অববাহিকায়, সমুদ্রের উপকূলে, পাহাড়ের ঢালে, মরুভূমির মধ্যে ইত্যাদি।
■ জলাভূমির বৈশিষ্ট্য কী?
= ইরানের রামসার শহর। বিমান থেকে যেমন দেখায়।
(1) জলাভূমি অগভীর বা গভীর জলে পূর্ণ থাকে তবে সাধারণত বর্ষাকালে এখানে জলের পরিমাণ বাড়ে। ফলে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এবং জোয়ার ভাটার প্রভাবে জলাভূমি অঞ্চলে জলের গভীরতা ও স্থায়িত্বের তারতম্য হতে পারে।
(2) জলাভূমি খোলা বা আবদ্ধ হতে পারে। এখানে জলতল স্থির হয়ে থাকতে পারে বা ওঠানামা করতে পারে। জলাভূমিতে জল আবদ্ধ বা বহমান হতে পারে।
(3) জলাভূমি এলাকার মাটি, আশপাশের মাটির থেকে আলাদা হয়। কারণ জলাভূমির মাটিতে কাদা ও পাঁকের পরিমাণ বেশি।
(4) এখানে জলজ উদ্ভিদের প্রাচুর্য লক্ষ করা যায়। যেমন উত্থিত, ভাসমান, নিমজ্জিত জলজ উদ্ভিদ। এছাড়া নদী মোহানা ও উপকূলীয় অঞ্চলের অনুকূল পরিবেশে মানগ্রোভ উদ্ভিদ ও কম অক্সিজেনে অভ্যস্ত উদ্ভিদও এখানে জন্মায়।
(5) ভূপৃষ্ঠের ওপর যে-কোনো নীচু জায়গায়, যেখানে জল জমে থাকতে পারে, সেখানেই জলাভূমি সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। তা প্লাবনভূমি, তৃণভূমি যাই হোক না কেন।
(6) জলাভূমির জল লবণাক্ত, কষা বা মিষ্টি স্বাদের হতে পারে।
(7) জলাভূমি যে-কোনো আয়তনের হতে পারে। অর্থাৎ কয়েক বর্গমিটার থেকে কয়েকশো বর্গ কিলোমিটার পর্যন্ত।
(8) মাটির নীচের জলস্তর (অর্থাৎ ভৌম জল) সাধারণত জলাভূমির খুব কাছাকাছি থাকে, ফলে অনেকক্ষেত্রেই মাটির নীচে জমে থাকা জল জলাভূমিতে জলের জোগান দেয়। আবার জলাভূমিও মাটির নীচে ভৌম জলস্তরে জলের জোগান দিয়ে প্রাকৃতিক জলভাণ্ডারকে পুষ্ট করে।
■ জলাভূমি কয় ধরনের ও কী কী?
= জলাভূমি প্রধানত তিন ধরনের যেমন—
(1) সামুদ্রিক বা উপকূলীয় জলাভূমি,
(2) স্থলভাগের অভ্যন্তরে অবস্থিত জলাভূমি,
(3) মানুষের তৈরি কৃত্রিম জলাভূমি।
■ প্রধান প্রাকৃতিক জলাভূমি কোন্ ধরনের ও কী কী?
= প্রধান প্রাকৃতিক জলাভূমি সাত ধরনের যেমন -
(1) সামুদ্রিক জলাভূমি (যেমন কচ্ছ প্রণালী [Gulf of Kachchh])
(2) মোহানা সংলগ্ন জলাভূমি (যেমন সুন্দরবন, তামিলনাড়ুর পিচাভরম [Pitchavaram])
(3) অভ্যন্তরীণ জলাভূমি (যেমন মধ্যপ্রদেশের ভোজ জলাভূমি)
(4) উপকূলীয় জলাভূমি (যেমন কেরালার অষ্টমুদি, ওড়িশার ভিতরকণিকা জলাভূমি)
(5) নদীসংলগ্ন জলাভূমি (যেমন পূর্ব কলকাতা জলাভূমি)
(6) স্বাদুজলের জলাভূমি (যেমন মণিপুরের লোকটাক হ্রদ)
(7) লবণাক্ত জলের জলাভূমি (যেমন রাজস্থানে সম্বর হ্রদ)
(৪) পার্বত্য এলাকার জলাভূমি (যেমন মানস সরোবর, জম্মু কাশ্মীরের সোমোরিরি এবং উলার)।
■ অর্থনৈতিক উপযোগিতার ভিত্তিতে জলাভূমি কয় ধরনের?
= অর্থনৈতিক উপযোগিতার ভিত্তিতে জলাভূমি তিন ধরনের যেমন -
(1) ডেরেলিক্ট (Derelict) অর্থাৎ মজে যাওয়া জলাভূমি। এর অর্থনৈতিক উপযোগিতা নেই।
(2) সেমি-ডেরেলিক্ট (Semi-derelict) অর্থাৎ বিপন্ন জলাভূমি। প্রায় মজে এসেছে। এই জলাভূমি সংস্কার
করে ব্যবহারযোগ্য করা যায়।
(3) কালচারেবল (Culturable) অর্থাৎ অর্থনৈতিক ভাবে উৎপাদনশীল জলাভূমি। মাছ চাষ ও অন্যান্য অর্থকরী কাজে এই ধরনের জলাভূমি ব্যবহারের উপযুক্ত।
■ পরিবেশ রক্ষায় জলাভূমির গুরুত্ব বা তাৎপর্য কী?
* জলাভূমির প্রাকৃতিক গুরুত্ব :
(1) বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা ও বৃষ্টির পরে রাস্তাঘাটে জল দাঁড়ানোর সময় কম করার জন্য : বন্যার অতিরিক্ত জল বা ভারী বর্ষণের পরে দ্রুত জলনিকাশের জন্য জলাভূমিগুলিকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার। কারণ এখানেই বন্যা ও বৃষ্টির জল শেষ পর্যন্ত জমা হওয়ার সুযোগ পায়।
(2) ভূগর্ভস্থ জলের জোগান দেওয়ার জন্য : জলাভূমির জল চুঁইয়ে মাটির নীচে ধীরে ধীরে যত নামতে থাকে, ভূগর্ভে জলের সঞ্চয়ও তত বাড়ে। ভূগর্ভে জলের এই সঞ্চয় যাতে রক্ষা করা যায়, তার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখা দরকার। নচেৎ চাষের জন্য সেচের জল, শহর এলাকায় ডিপ টিউবওয়েল থেকে পানীয় জল পাওয়ার সম্ভাবনা আস্তে আস্তে কমবে।
(3) জলের গুণগত মান বজায় রাখার জন্য : জলাভূমিতে যেসব জলজ উদ্ভিদ ও শৈবাল জন্মায়, তাদের মধ্যে অনেকেই জলে গুলে থাকা অর্থাৎ দ্রবীভূত হওয়া রাসায়নিক পদার্থগুলিকে শোধন করতে পারে। ফলে প্রায় বিনা খরচে জলাভূমির কল্যাণে প্রাকৃতিক উপায়ে জলশোধন হয়। এই কারণে জলাভূমিকে “প্রকৃতির কিডনি”, “শহর-নগরের কিডনি” (Natural Kidney, Urban Kidney) বলা হয়।
(4) জৈব বৈচিত্র্যকে রক্ষা করার জন্য : জলাভূমির মধ্যে বেঁচে থাকা জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ ছাড়াও পরিযায়ী পাখিরা আসে ৷ জলাভূমি নষ্ট করলে ছোটো শৈবাল থেকে বড়ো বড়ো পাখি, মাছ ও অন্যান্য সরীসৃপের প্রাণ সংশয় হবে এবং বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হবে।
(5) সামুদ্রিক ঝড়, তুফান থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ও উপকূলের ক্ষয় রোধ করার জন্য : উপকূল সংলগ্ন এলাকায় বড়ো বড়ো জলাভূমি থাকলে সমুদ্রের ঝড়, তুফান সরাসরি জনবসতির ওপর আছড়ে পড়তে পারে না। জলাভূমির বিস্তার এবং জলাভূমিকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠা বনভূমি এই ঝড়, তুফানের তীব্রতা কমিয়ে দেয়। ফলে একদিকে যেমন বড়ো বড়ো ঢেউগুলি জলাভূমির মধ্যেই ভেঙে যায়, তেমনি অন্যদিকে উপকূলের জমিও ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পায়।
(6) জলবায়ুর পরিবর্তনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য : বিশ্ব উষ্ণায়নের হার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জলাভূমি দরকার। কারণ জলাভূমি ও জলাভূমির উদ্ভিদ CO, শোষণ করে প্রকৃতিকে গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাব থেকে কিছুটা মুক্ত করে।
(7) প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বজায় রাখার জন্য : জলাভূমি পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। জলাভূমির নিজস্ব একটি নান্দনিক আকর্ষণ আছে।
জলাভূমির অর্থনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্ব :
(1) মাছ চাষের মাধ্যমে জীবিকার সুযোগ তৈরি করার জন্য ও বাজারে মাছের চাহিদা মেটানোর জন্য জলাভূমির গুরুত্ব আছে।
(2) পদ্ম, শালুক, পানিফল প্রভৃতি অর্থকরী ফসলকে লাভজনকভাবে চাষ করার জন্য জলাভূমি রক্ষা করা জরুরি।
(3) ইকো-ট্যুরিজমের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হলে জলাভূমিগুলিকে কেন্দ্র করে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়ে তোলা যায়।
(4) ঘন জনবসতি এলাকায় প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম যে-কোনো ধরনের জলাশয়কে রক্ষা করার দরকার আছে কারণ জলাশয়ের জল দমকল ব্যবহার করতে পারে, জলাশয়ের চারপাশে বাগান, পার্ক, প্রাতঃভ্রমণের রাস্তা, বসার ও বিশ্রামের জায়গা তৈরি করে নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য বাড়ানো যায়।
■ রামসার সাইট বা রামসার ক্ষেত্র কাকে বলে?
1971 সালে UNESCO-র আগ্রহে রামসার সম্মেলনে (Ramsar Convention) বিশ্বের যে গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমিগুলিকে চিহ্নিত করা হয়, তাদের রামসার সাইট (Ramsar site) বা রামসার ক্ষেত্র বলে।
■ রামসার সম্মেলনের গুরুত্ব কী ?
রামসার সম্মেলনে (Ramsar Convention) বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমিগুলির সংরক্ষণ, জলের সুস্থায়ী ব্যবহার, বেআইনি দখলদারী (encroachment) বন্ধ করা ও জলাভূমিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য রামসার চুক্তি হয়। এখানে উল্লেখ্য যে রামসার চুক্তি হল একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি। তবে চুক্তি লঙ্ঘনের শাস্তি হিসেবে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেই।
■ মনত্রু রেকর্ডস কী?
মনত্রু রেকর্ডস (Montreux Records) হল রামসার লিস্ট-এর অন্তর্গত বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জলাশয়গুলির তালিকা, যে জলাশয়গুলিতে দূষণ, মানুষের হস্তক্ষেপ, শিল্পায়ন, নগরায়ণ বা অন্য কোনো কারণে পরিবেশগত পরিবর্তন ঘটেছে, ঘটে চলেছে এবং আগামী দিনে ওই ধরনের পরিবর্তন ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। যেমন— ওড়িশার চিলিকা হ্রদ।
■ জলাভূমির সমস্যা কি?
(1) জলাভূমিতে কৃষিজমি, কলকারখানা, ঘর-গৃহস্থালির রাবিশ, আবর্জনা, দূষিত জল ও বর্জ্য, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ফেলা হয় বা জলপ্রবাহের সঙ্গে এসে মেশে। ফলে জলাভূমি দূষিত হয়।
(2) জলাভূমি বুঝিয়ে চড়া দামে জমি বিক্রি করার কাজ চলে। নগরায়নের ও শিল্পায়নের জন্য জমির চাহিদা মেটানোর উদ্দেশ্যেই এই বেআইনি কাজ চলছে।
(3) ইউট্রোফিকেশনের কারণে জলাভূমি বুজে নষ্ট হয়। পলি অবক্ষেপণের কারণেও জলাভূমির বিনাশ ঘটে।
No comments:
Post a Comment